সিবিএন রিপোর্ট:
কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক ধরে গেলে বালুখালী পানবাজারস্থ সড়ক লাগোয়া দক্ষিণ-পূর্ব পাশে দ্বিতল একটি ভবন আপনার চোখ আটকে দিতে পারে। স্বাভাবিকভাবে আপনার এই চোখ আটকানোর কারণ হতে পারে মিয়ানামার থেকে পালিয়ে আসা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের জটলা! তবে আপনাকে একটু খেয়াল করতে হবে কেন এই জটলা? তারপর দেখবেন মানবিকতার এক মোহনীয় দৃশ্য। যেখান থেকে স্বস্তি আর হাসিমুখে ফিরছে ‘রোহিঙ্গার দল’। বলা হচ্ছে, বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ড্যাব’র ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের কথা। যেটি রোহিঙ্গাদের মাঝে ‘খালেদা জিয়ার হাসপাতাল’ নামে পরিচিত। সেখানে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের দেয়া হচ্ছে আধুনিক চিকিৎসা সেবা। নির্যাতনে আহত ও নানা রোগে আক্রান্ত সব রোহিঙ্গা পেয়ে যাচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন সেবা। বিরামহীন ও উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা দিয়ে রোহিঙ্গা আস্থা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে এই মেডিকেল ক্যাম্পটি।

ড্যাবের ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা নিচ্ছে  এক রোহিঙ্গা্

তথ্য মতে, নিজ দেশের সেনাবাহিনী ও রাখাইনদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পটি প্রতিষ্ঠা করেছে ড্যাব। ১২ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গাদের দেখতে এই ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পটি উদ্বোধন করেছিলেন বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। সেই থেকে এখন পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে এই ক্যাম্পটি। বিএনপির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এই মেডিকেল পরিচালিত হচ্ছে।

এই মেডিকেল ক্যাম্পের সমন্বয়ক ড্যাব’র মহাসচিব ও বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান এ.জেড.এম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘নিষ্ঠুর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য বিএনপি শুরু থেকেই নানা ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তার মাঝে আমরা খেয়াল করেছি অন্যান্য মানবিক সহায়তায় মতো চিকিৎসা সেবাও অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ পালিয়ে আসাদের মধ্যে অনেক রোহিঙ্গা হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে গুলিবিদ্ধসহ নানাভাবে আহত ছিলো। একইভাকে বেশ কয়েকদিনের অভুক্ত, বাস্তুহারা হয়ে পাহাড়-জঙ্গলে থাকতে গিয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হয়। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা ও তারেক রহমানের নির্দেশে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে ড্যাব।’

নবপ্রতিষ্ঠিত অপারেশন থিয়েটার পর্যবেক্ষণ করছেন ড্যাবের মহাসচিব ডা. জাহিদ হোসেন।

ডা. জাহিদ হোসেন জানান, ড্যাবের এই মেডিকেল ক্যাম্পে প্রতিটি রোগের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। শুরুতেই গুলিবিদ্ধসহ নানাভাবে জখম রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা করা হয়েছিল। এমনকি শরীর থেকে গুলিও বের করা হয়েছিল। এছাড়া, গর্ভবতী ও প্রসূতি মহিলাদের পুরো চিকিৎসা, নিমোনিয়া, ডায়রিয়া, টাইফয়েড, ডিপথেরিয়া, চর্মরোগ, হেপাটাসিস-বি পজেটিভ, পেটের পীড়া রোগী বেশি। পাশপাশি গর্ভবতী ও প্রসূতি মা ও শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবারও দেয়া হচ্ছে। রোগ নির্ণয়ের জন্য এইডস পরীক্ষা, ১২ ধরণের বায়োকেমিস্ট্র পরীক্ষা, ১২ ধরণের রক্ত পরীক্ষা, প্র¯্রাব পরীক্ষা করা হয়। এই জন্য একটি আধুনিক মানের ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সংকটাপন্ন হলে উখিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতালে রেফার করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা- সন্তান ডেলিভারির জন্য ১ ফেব্রয়ারি থেকে অপারেশন থিয়েটার চালু হচ্ছে। চিকিৎসা সেবায় বিভিন্ন সময়ে কয়েক শ’ চিকিৎসক এখানে চিকিৎসা দিয়েছেন এবং নিয়মিত ১০ জন চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টসহ ১৫জন মতো লোকজন নিয়োজিত রয়েছে।

তিনি জানান, প্রথম দিনে সাড়ে ছয় হাজার রোগীকে চিকিৎসা দিতে হয়েছিল। প্রথম দিকে প্রতিদিন পাঁচ হাজারের কাছাকাছি রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিতে হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক দু’হাজারের মতো রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এই পর্যন্ত তিন লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়েছে। বাচ্চা ও মহিলা রোগীর সংখ্য বেশি। স্থানীয় জনগণ, বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মেডিকেল ক্যাম্পটি চলছে।

নবপ্রতিষ্ঠিত অপারেশন থিয়েটারের একাংশ।

চিকিৎকদের সমন্বয়কারী ডা. মেহেদী হাসান বলেন, ‘সকাল থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত এক নাগাড়ে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। রোগ নির্ণয়ের পর প্রতিটি ব্যবস্থাপত্রসহ রোগীকে দু’দিনের মতো ওষুধ দিই। মূলত ওষুধ সেবনে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সে জন্য দু’দিন পর আবার ওষুধ দেয়া হয়।’

সরেজমিনে কথা হলে রোহিঙ্গারা ড্যাবের চিকিৎসা নিয়ে তাদের আস্থা ও সন্তোষ্টির কথা জানান। খালেদা জিয়ার হাসাপাতাল উল্লেখ করে বুচিদং থেকে পালিয়ে আসা হাছিম আলী (৫০) জানান, তিনি জ্বর ও পেটের পীড়া আক্রান্ত হন। বাইরের মেডিকেল ক্যাম্প থেকে কয়েকবার চিকিৎসা নিয়েও কোনো কাজ হয়নি। শেষে ‘খালেদা জিয়ার হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিয়ে ভালো লাগছে। ওষুধ শেষ হয়ে যাওয়ায় আবার ওষুধের জন্য এসেছিলেন তিনি।
মংডু থেকে পালিয়ে আসা ডায়বেটিকস রোগী আমিন খাতুন (৪০) জানান, কয়েকটি মেডিকেল ক্যাম্পে গেলেও কোথাও তাকে ডায়বেটিকসের ওষুধ দেয়া হয়নি। এতে তিনি অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। খবর পেয়ে কুতুপালং থেকে বালুখালীর ড্যাবের মেডিকেল ক্যাম্পে আসেন এবং সেখান থেকে ওষুধ পান।

বুচিদং থেকে পালিয়ে আসা হাপানি রাবিয়া খাতুন (৬০) জানান, তিনি দীর্ঘদিনের হাপানি রোগী। এর মধ্যে জ্বর চলছে কয়েকদিন ধরে। দু’তিনটি মেডিকেল ক্যাম্প থেকে ওষুধ খেয়ে তিনি সুস্থ হননি। শেষে ড্যাবের মেডিকেল ক্যাম্পে এসেছেন। এখান ওষুধ প্রয়োজন মতো ওষুধ পেয়ে তিনি খুশি হয়েছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের মেডিকেল ক্যাম্পটির একটি বিশেষত্ব রয়েছে। তাহলো সার্বক্ষণিক চিকিৎসক থাকে। পাশাপাশি ওষুধ বিতরণ নয়, রোগ নির্ণয় করেই যথাপযুক্ত ওষুধ দিই। সেটা যতই দামি হোক। আস্থার জন্য রোহিঙ্গারা আমাদের কাছে আসে। ইউএন, আইওম, ব্র্যাক, মুক্তি- এমনকি অস্থায়ী সরকারি মেডিকেল ক্যাম্প থেকেও ব্যবস্থাপত্র নিয়ে আমাদের কাছে ওষুধ নিতে আসে। অফিসিয়ালিও তারা আমাদের কাছে পরামর্শ নেয়। রোগী রেফার করে।’

তিনি আরো বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকটের শুরুতে যখন কোনো চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা গড়ে উঠেনি তখন থেকেই আমরা ক্যাম্প চালু করি। এই ক্যাম্প চালাতে গিয়ে সবার আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি বা পাচ্ছি। এনজিও আমাদের সহযোগিতা করেনি। দলীয় সহযোগিতা ছাড়াও রোহিঙ্গাদের দেখতে আসা অনেকে এবং দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আমাদের ওষুধ দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা সেলিম জাহাঙ্গীর তাঁর ভবনটি ফ্রিতে আমাদের ব্যবহার করতে দিচ্ছেন।’

স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন লাইন ধরে ধরে রোহিঙ্গারা ড্যাবের মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা নিতে আসেন। এটি রোহিঙ্গার কাছে ‘খালেদায় জিয়ার হাসপাতাল’ হিসেবে এক নামে পরিচয় লাভ করেছে।

রোহিঙ্গাদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করছেন ডা. জাহিদ হোসেন, জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী ও দপ্তর সম্পাদক ইউসুফ বদরী।

ড্যাবের ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনায় নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রয়েছেন কক্সবাজার জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ইউসুফ বদরী। শুরু থেকে তিনি নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখেন এই ক্যাম্পের। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গার আসার শুরুতে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২৭ আগষ্ট এক বিবৃতিতে নির্যাতিনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও সহযোগিতা দেয়ার জন্য বিএনপি নেতকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। একই সাথে বিশ্ববাসীর কাছেও একই আহ্বান রেখেছিলেন তিনি। সেদিন থেকে বিএনপির নেতাকর্মীরা রোহিঙ্গাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তারই ধারবাহিকতায় ড্যাবের মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপিত হয় এবং এই মেডিকেল ক্যাম্প থেকে সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা পেয়ে আসছে রোহিঙ্গারা।’

কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘একদম শুরুতেই রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছে বিএনপি। সরকার যখন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের গুলি করে তাড়িয়ে দিয়েছিল তখন এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। একই সাথে তাদের মানবিক আশ্রয় দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ওনার আহ্বানে বিএনপির নেতাকর্মীরা রোহিঙ্গাদের সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছে।’

প্রসঙ্গত, ড্যাব ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসার পাশপাশি নির্যাতি রোহিঙ্গাদের মাঝে ১৫ হাজার  শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে।